জানা নিউজ

যুদ্ধে জড়ানোর বিবেচনায় ট্রাম্প, তেহরান ছাড়ছে মানুষ

ইরান ইসরায়েল যুদ্ধ বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ইসরায়েলি হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করছেন বলে খবর দিয়েছে রয়টার্স। এদিকে ট্রাম্প তেহরানবাসীকে শহর ছাড়ার আহ্বান জানানোর পর হাজারো মানুষ ইরানের রাজধানী ছেড়ে গেছেন। ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলা ষষ্ঠ দিনে গড়ানোর মধ্যেই ট্রাম্প যখন তেহরানের কাছে ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের’ দাবি তুললেন, তখনও দুই পক্ষ একে অপরের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছিল। ইসরায়েল তেহরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দাদের এলাকা ছাড়তে বলে, যাতে ইরানি সামরিক স্থাপনাগুলোর ওপর বিমান হামলা চালানোর সময় বেসামরিক প্রাণহানি কমে। ইরানি সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, রাজধানী তেহরান থেকে উত্তরের প্রদেশগুলোর পথে শহর ছাড়ার মিছিলে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়েছে। জ্বালানি সরবরাহ ঠিক রাখতে তেহরানে তেল বিক্রির সীমা বেঁধে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ইরানের তেলমন্ত্রী মোহসেন পাকনেজাদ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলেছেন, সংকট ঠেকাতেই এই বিধিনিষেধ, তবে জনসাধারণের জন্য জ্বালানির জোগানে কোনো সমস্যা হবে না। এদিকে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। দেশটির সেনাবাহিনী জানিয়েছে, গতকাল বুধবার ভোরের প্রথম দুই ঘণ্টায় ইরান দুই দফা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা মেহর জানিয়েছে, তেহরানের দক্ষিণে রেই শহরে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের সংঘর্ষ হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলাকারীরা ‘সম্ভবত ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত’ এবং রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় তাদের ‘সন্ত্রাসী হামলা’ চালানোর উদ্দেশ্য ছিল। ইরানের সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, দেশটির পূর্বাঞ্চলে ইরানের বিপ্লবী গার্ডসের সঙ্গে যুক্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজধানীর কাছে খোজির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনাতেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গত অক্টোবরেও সেখানে বিমান হামলা হয়েছিল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স লিখেছে, মঙ্গলবার রাতে ৫০টি যুদ্ধবিমান তেহরানে প্রায় ২০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কাঁচামাল উৎপাদনের কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনাও ছিল এর মধ্যে। ইরানের কর্মকর্তারা বলেছেন, গত শুক্রবার ভোরে ইসরায়েল হামলা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২২৪ জন নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। তবে গত কয়েকদিনে সেই সংখ্যা হালনাগাদ করা হয়নি। ইরান গত শুক্রবার থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪০টি ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে আঘাত হেনেছে। তাতে অন্তত ২৪ জন নিহত হয়েছেন, তারা সবাই বেসামরিক নাগরিক বলে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের দাবি। ইরানের ওপর আকস্মিক সামরিক অভিযান শুরুর পর বিপুল সংখ্যক ইসরায়েলি বিদেশে আটকা পড়েনে। তাদের ফেরাতে গতকাল বুধবার থেকে ধাপে ধাপে ফ্লাইট চালাচ্ছে ইসরায়েল। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। ইসরায়েল বলছে, তাদের মূল লক্ষ্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা। তবে ইরানের ফরদোর পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র একটি পাহাড়ের নিচে অবস্থিত, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভারী বোমাগুলোই কেবল আঘাত হানতে পারে। একটি সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স লিখেছে, ট্রাম্প ও তার উপদেষ্টারা সবগুলো বিকল্প বিবেচনা করে দেখছেন। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর ইসরায়েলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের যোগ দেওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টিও রয়েছে এর মধ্যে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে মঙ্গলবার ফোনে কথা বলেন ট্রাম্প। পরে বিকেলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে প্রায় ৯০ মিনিট ধরে বৈঠক করেন। একাধিক সামাজিক মাধ্যমে একের পর এক পোস্টে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার সম্ভাবনা নিয়েও মন্তব্য করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ট্রুথ সোশালে তিনি লেখেন, “আমরা জানি, তথাকথিত ‘সর্বোচ্চ নেতা’ কোথায় লুকিয়ে আছে। আমরা তাকে হত্যা করব না (অন্তত এখনই না)… আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।” তার তিন মিনিট পর ট্রাম্প ইরানকে উদ্দেশ্য করে এক পোস্টে লেখেন, “নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ!” যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েল এবং দীর্ঘদিনের শত্রু ইরানের মধ্যকার এই সংঘাত নিয়ে ট্রাম্পের বারবার দিক পরিবর্তন ও অস্পষ্ট বার্তায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। কখনো তিনি সামরিক হুমকি দিচ্ছেন, আবার কখনো কূটনৈতিক সমাধানের আভাস দিচ্ছেন। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আরও যুদ্ধবিমান মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাচ্ছে। আগে থেকে সেখানে থাকা কিছু মিশনের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতে ভূমিকা রেখেছে পরোক্ষভাবে। ইসরায়েলের দিকে ধেয়ে যাওয়া ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সহায়তা করছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি যুদ্ধে জড়ায়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হানার হুমকি দিয়েছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা রিপোর্ট দেখতে পারেন, এমন এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স লিখেছে, ইরান কিছু ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণযন্ত্র আগের অবস্থান থেকে সরিয়েছে। তবে সেগুলো এখন মার্কিন বাহিনী না ইসরায়েলের দিকে তাক করা হয়েছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রয়টার্স লিখেছে, ইসরায়েলের হামলায় ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির শীর্ষ সামরিক ও নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের অনেকে নিহত হয়েছেন। তাতে তার ঘনিষ্ঠ বলয় দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং কৌশলগত ভুলের আশঙ্কা বেড়েছে। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর এটাই সবচেয়ে বড় আঘাত। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির সাইবার নিরাপত্তা বিভাগ সরকারি কর্মকর্তাদের মোবাইল ও যোগাযোগ যন্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলে ফার্স নিউজ জানিয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইরান সমর্থিত হামাস ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে গাজা যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে ইসরায়েল গাজায় হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনে হুতি এবং ইরাকের মিলিশিয়াদের ওপর টানা হামলা চালিয়ে আসছে। ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র, সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদও ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তেু এমন দাবি করে ইসরায়েল শুক্রবার আকাশপথে হামলা শুরু করে। ইরান বরাবরই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টার কথা অস্বীকার করে আসছে। তাদের দাবি, তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত তিনি পিছু হটবেন না। আর ট্রাম্প বলেছেন, ইরান যদি তাদের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি থেকে সরে আসে, তাহলে ইসরায়েলের হামলাও থেমে যেতে পারে।