ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর ভয়াবহ হামলা নতুন করে রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি তৈরি করেছে, এমন সময়ে যখন যুদ্ধবিরতি চুক্তির আলোচনায় আশার সঞ্চার হয়েছিল। গত রোববার গাজাজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৮২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আল-জাজিরা। এর মধ্যে গাজা সিটিতেই প্রাণ হারিয়েছেন ৩৯ জন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় চলমান হামলায় এখন পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৪১৮ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন এক লাখ ৩৬ হাজার ২৬১ জন। ইসরায়েলি হামলার ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে গাজা শহরের শেখ রাদওয়ান এলাকার বাসিন্দা মাহমুদ আল-শেখ সালামা জানিয়েছেন, গত শনিবার রাত ২টার দিকে (জিএমটি ২৩:০০) ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর বাড়িতে হামলা হয়। তিনি বলেন, “আমরা প্রথমে একটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম এবং কিছুক্ষণ পর আরেকটি। আমরা দ্রুত ছুটে যাই এবং দেখি ধ্বংসস্তূপের নিচে মানুষ আটকা পড়েছে। চারটি পরিবার এবং অনেক বাসিন্দা ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়েছিলেন।” তিন ঘণ্টার প্রচেষ্টায় দুজনকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও বাকিরা শহীদ হয়েছেন এবং এখনো অনেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা আছেন বলে জানান তিনি।
আল-জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ গাজা সিটি থেকে জানিয়েছেন, মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে গাজা উপত্যকায় অন্তত সাতটি বিমান হামলা হয়েছে। এছাড়া দেইর এল-বালাহের উত্তরাংশে স্থানীয় একটি কমিউনিটি রান্নাঘরেও হামলা হয়, যাতে তিনজন নিহত হন, যাদের মধ্যে রান্নাঘরের মূল পরিচালনাকারীও আছেন।
এদিকে, গাজার দক্ষিণে নেটজারিম করিডোরের কাছে ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের আশেপাশে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে অন্তত পাঁচজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আল-জাজিরা জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে পরিচালিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) কেন্দ্রগুলোতে ত্রাণ নিতে গিয়ে হামলার শিকার হচ্ছেন স্থানীয়রা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, মে মাসের শেষদিক থেকে জিএইচএফ পরিচালিত কেন্দ্রগুলোর আশেপাশে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৭৪৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন চার হাজার ৮৯১ জন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন গত জুনের শেষ দিকে জিএইচএফকে ৩০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে গাজাবাসীর অভিযোগ, ইসরায়েলি বাহিনী এই কেন্দ্রগুলোর আশেপাশেই প্রায়ই হামলা চালাচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, জিএইচএফই একমাত্র সংগঠন, যারা এখনো গাজায় কার্যকরভাবে ত্রাণ সরবরাহ করতে পারছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস আকস্মিক হামলা চালায় ইসরায়েলে। ওই হামলায় অন্তত ১২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং প্রায় ২৫১ জনকে হামাস যোদ্ধারা জিম্মি করে নিয়ে যায়। এর পর থেকেই গাজায় বড় আকারের সামরিক অভিযান চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি বাহিনী।
এই রক্তক্ষয়ী প্রেক্ষাপটেই যুদ্ধবিরতির ইঙ্গিত দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত রোববার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমার বিশ্বাস, এই সপ্তাহেই গাজা নিয়ে হামাসের সঙ্গে একটি সমঝোতা হতে পারে। আমাদের বেশ কয়েকজন জিম্মিকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে, এবং আশা করি বাকিদের বিষয়েও এই সপ্তাহের মধ্যেই সমাধান হবে।”
মধ্যস্থতার জন্য কাতারে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে এএফপি। আলোচনায় জিম্মি বিনিময় এবং যুদ্ধবিরতির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কথাবার্তা চলছে। ট্রাম্প জানিয়েছেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে তাঁর বৈঠক সোমবার হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, নেতানিয়াহুর সঙ্গে এ বৈঠক যুদ্ধবিরতি চুক্তি এগিয়ে নেবে।
অন্যদিকে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, নেতানিয়াহু নিজ রাজনৈতিক অবস্থান শক্ত করতে এবং তাঁর বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতির মামলাগুলোকে প্রভাবিত করতে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইছেন। কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক আদনান হায়াজনে আল-জাজিরাকে বলেছেন, “ইসরায়েল এবং নেতানিয়াহুর যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহ নেই। ইসরায়েল যে চায়, তা স্পষ্ট-একটি জনশূন্য ভূখণ্ড।” তাঁর মতে, ফিলিস্তিনিদের সামনে তিনটি পথ রয়েছে-ক্ষুধায় মারা যাওয়া, বোমায় নিহত হওয়া অথবা ভূমি ছেড়ে চলে যাওয়া। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা প্রমাণ করেছে, তারা কোনোভাবেই তাদের ভূমি ছাড়বে না।
গাজায় রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মধ্যেই সামনের দিনগুলোতে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। মানবিক সংকট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতায় এই অঞ্চল ক্রমেই আরও অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে।