নারী রাজনীতিকদের জন্য নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ তৈরির দাবিতে এবার সরব হলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সদস্য নীলা ইসরাফিল। দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক (স্থগিত) সরোয়ার তুষারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, অনৈতিক আচরণ ও মানসিক নিপীড়নের অভিযোগ তুলে তিনি একটি লিখিত অভিযোগপত্র দিয়েছেন এনসিপির গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে। বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সেই অভিযোগপত্র প্রকাশ করেন তিনি।
অভিযোগপত্রে নীলা ইসরাফিল নিজের রাজনৈতিক অবস্থান ও অভিজ্ঞতার বর্ণনার মধ্য দিয়ে অভিযোগের পটভূমি তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, রাজনীতি তার কাছে কোনো পদ বা লাভের বিষয় নয়, বরং এটি একটি নৈতিক ও আদর্শিক লড়াই। তিনি জানান, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন এবং শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। সেই সময় এনসিপির নেতাদের মধ্যে সরোয়ার তুষার তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, যা শুরুতে সহানুভূতিশীল মনে হলেও পরে তা ব্যক্তিগত ও যৌন হয়রানির পর্যায়ে পৌঁছায়।
নীলা অভিযোগ করেন, তুষার তাকে প্রায়ই রাতে ফোন করে আপত্তিকর ভাষায় কথা বলতেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, “রাজনীতি নিয়ে কথা ভালো লাগে না, তোমার কণ্ঠে প্রতিবাদের স্লোগান ভালো লাগে,” “তোমার ঠোঁট সুন্দর,” “একটা সুন্দর ছবি পাঠাও”—এই ধরনের মন্তব্য তাকে বারবার অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। তিনি জানান, তুষার ভিডিও কলে কথা বলার জন্য চাপ দেন এবং ছবি চেয়ে বিরক্ত করতেন।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, একপর্যায়ে তুষার দাবি করেন, “ডিবি অফিসার আমাকে তোমার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে আমি বলেছি, তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড।” এ ধরনের অসত্য ও দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য একজন রাজনৈতিক সহকর্মীর জন্য অপমানজনক এবং তার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার শামিল বলে মনে করেন নীলা।
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বেশ কয়েকটি ফোনালাপ রেকর্ড করেন, যার একটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ১৬ জুন। এরপর তুষার তাকে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে বিষয়টি অস্বীকার করতে বলেন। নীলা এরপর আরও দুটি ফোনালাপ রেকর্ড করেন এবং সেগুলো কিছু মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের মাধ্যমে প্রকাশ করতে সম্মত হন।
নীলা অভিযোগ করেন, দলের ভেতর থেকে এ বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ৭ জুন ঈদের রাতে তিনি এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে বিষয়টি জানান এবং তুষারের পাঠানো আপত্তিকর বার্তাগুলো দেখান। পরবর্তীতে ১৫ জুন মহানগর প্রতিনিধিদেরও বিষয়টি জানান। এরপর তিনি দলের জ্যেষ্ঠ নেত্রী সামান্তা শারমীনকে বিষয়টি অবগত করেন।
অভিযোগপত্রে নীলা দাবি করেন, ঘটনার পরে তিনি এনসিপির প্রধান কার্যালয়ে গিয়েও কার্যকর কোনো সাড়া পাননি। ১৯ জুন তাঁকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দিতে বলা হয়, তবে এরপরও দলীয়ভাবে তাঁর প্রতি কোনো সহানুভূতি বা সুরক্ষা প্রদান করা হয়নি।
অভিযোগপত্রে তিনি একটি নিরপেক্ষ, নারীবান্ধব ও স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন। একইসঙ্গে নারী কর্মীদের জন্য একটি স্বচ্ছ অভ্যন্তরীণ অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থাপনা চালুর দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “সত্য বলার পর যে মানসিক নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হবে, তা কল্পনাও করিনি। আমার লিখা ও রেকর্ডিং তুষারের অপরাধের প্রমাণ, মব ট্রায়ালের অংশ নয়।”
নীলা ইসরাফিল অভিযোগ করেছেন, সরোয়ার তুষারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, হোয়াটসঅ্যাপ ও ব্যক্তিগত গ্রুপে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার, কুৎসা ও ডিজিটাল লিঞ্চিং শুরু হয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “আপনাদের চেতনা ও নৈতিকতা কি শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ, বাস্তবে নয়?”
এ বিষয়ে সরোয়ার তুষারের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এনসিপি কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
নীলার বক্তব্য রাজনৈতিক পরিসরে নারীর নিরাপত্তা, সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দলটি কী পদক্ষেপ নেয়, সে দিকেই এখন নজর রাজনৈতিক মহলের।