ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি হামলার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপজুড়ে বড় ধরনের সামরিক সরণ ঘটিয়েছে। অন্তত ৩০টি মার্কিন ট্যাংকার জেট ইতোমধ্যে ইউরোপে মোতায়েন করা হয়েছে এবং দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস নিমিট্জ মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব তৎপরতা যুদ্ধের প্রস্তুতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রোববার (১৫ জুন) পর্যন্ত বিবিসি, রয়টার্স ও ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইটগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র গত তিন-চার দিনের মধ্যে তাদের বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে অন্তত ৩০টি ট্যাংকার উড়োজাহাজ ইউরোপে সরিয়ে নিয়েছে। এই উড়োজাহাজগুলো মূলত আকাশে যুদ্ধবিমান ও বোমারু বিমানকে জ্বালানি সরবরাহে ব্যবহৃত হয়।
ফ্লাইটরাডার টোয়েন্টিফোর-এর তথ্য অনুসারে, এই উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে অন্তত ৭টি কেসি-১৩৫ মডেলের জেট স্পেন, স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডে মার্কিন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করেছে। এরপর সেগুলো ইউরোপের বিভিন্ন আকাশপথে বিচরণ করেছে। এর মধ্যে ছয়টি বিমান নির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়াই উড়েছে, একটি অবশেষে গ্রিসের ক্রেট দ্বীপে অবতরণ করে।
বিবিসি ভেরিফাই বিভাগ এসব বিমানের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত করেছে যে তাদের গন্তব্য সাধারণভাবে দেখা যাওয়া কার্যক্রম থেকে ভিন্ন। মঙ্গলবার বিকেলে এই বিমানের একটি দলকে ইতালির সিসিলি দ্বীপের পূর্ব দিকে উড়তে দেখা গেছে।
এদিকে, দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থানরত মার্কিন নৌবাহিনীর বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস নিমিট্জকেও মধ্যপ্রাচ্যের দিকে পাঠানো হয়েছে। এটি মূলত ভিয়েতনামের দানাং বন্দরে যাওয়ার কথা থাকলেও ‘জরুরি পরিস্থিতির কারণে’ যাত্রাপথ পরিবর্তন করা হয়েছে বলে জানায় হ্যানয়ের মার্কিন দূতাবাস। রণতরীটির গতিপথ পর্যবেক্ষণকারী ‘মেরিন ট্রাফিক’ ওয়েবসাইটের তথ্যে জানা যায়, মঙ্গলবার ভোরের আগে এটি মালাক্কা প্রণালীতে অবস্থান করছিল এবং সিঙ্গাপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
এই রণতরীতে বহু যুদ্ধবিমান এবং গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ারসহ একাধিক সহযোগী যুদ্ধজাহাজও যুক্ত থাকে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েনের অর্থই হচ্ছে—সেখানে সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এসব পদক্ষেপ কেবল কৌশলগত নয়—বরং সরাসরি যুদ্ধ সম্ভাবনারই ইঙ্গিত। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউট (রুসি)–এর জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক জাস্টিন ব্রঙ্ক বলেন, “এতগুলো ট্যাংকার বিমান একসঙ্গে ইউরোপে আনা ‘স্বাভাবিক কিছু নয়’। এটি মধ্যপ্রাচ্যে আসন্ন সামরিক অভিযানকে ঘিরে একটি জোরালো পূর্বপ্রস্তুতির ইঙ্গিত।”
এমনকি আয়ারল্যান্ডের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাবেক প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল মার্ক মেলেট পর্যন্ত বলেছেন, “এগুলো ইরানকে ভয় দেখাতেও মোতায়েন করা হয়ে থাকতে পারে—যাতে তারা তাদের পরমাণু কর্মসূচিতে ছাড় দিতে বাধ্য হয়।”
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসরায়েল কিছু হামলা চালালেও তেহরানের ফোরদো বা নাতাঞ্জের মতো স্থাপনায় তারা বড় ক্ষতি করতে পারেনি। এসব স্থাপনা ধ্বংসে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করতে হতে পারে বিশেষ ধরনের বোমা—জিবিইউ-৫৭এ/বি ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর, যা ‘বাংকার ব্লাস্টার’ নামে পরিচিত। এটি প্রায় ১৩ হাজার ৬০০ কেজি ওজনের এবং ২০০ ফুট গভীর কংক্রিট ভেদ করতে সক্ষম।
এই বোমা কেবল বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান বহন করতে পারে। সম্প্রতি ভারত মহাসাগরে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়ায় এই বিমানের উপস্থিতি দেখা গেছে। যদিও সর্বশেষ উপগ্রহচিত্রে বিমানগুলো নেই, তবুও বিশ্লেষকরা এটিকে যুদ্ধ পরিকল্পনারই অংশ বলে ধারণা করছেন।
ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর সাবেক ডেপুটি অপারেশন চিফ এয়ার মার্শাল গ্রেগ ব্যাগওয়েল বলেন, “এই বোমার সাহায্যে যুক্তরাষ্ট্র দূর থেকেই হামলা চালাতে সক্ষম। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকেও।”
এই মুহূর্তে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি হামলা, যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী সামরিক প্রস্তুতি ও রণতরী মোতায়েন একটি সম্ভাব্য বৃহৎ যুদ্ধের আশঙ্কাকে উসকে দিচ্ছে। যদিও হোয়াইট হাউস বা পেন্টাগনের পক্ষ থেকে এখনো সরাসরি যুদ্ধ জড়িত হওয়ার ঘোষণা আসেনি, তবে এই সামরিক পদক্ষেপগুলোর ভাষা নিঃসন্দেহে যুদ্ধমুখী।