জানা নিউজ

ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা: ঈদযাত্রায় ১২ দিনে ৩১২ প্রাণহানি

ঈদুল আজহার আগে ও পরে মাত্র বারো দিনের মধ্যে দেশের সড়কপথে প্রাণ হারিয়েছেন তিন শতাধিক মানুষ। যাত্রীদের জন্য আনন্দের ঈদযাত্রা পরিণত হয়েছে ভয়াবহ মৃত্যুযাত্রায়। ঈদকে ঘিরে অতিরিক্ত যাত্রীচাপ, যানবাহনের অনিয়ম ও সড়ক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার চিত্র উঠে এসেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বুধবার (১৮ জুন) এক প্রতিবেদনে জানায়, গত ৩ জুন থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত ১২ দিনে দেশে ৩৪৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১ হাজার ৫৭ জন। নিহতদের মধ্যে নারী ৪৭ জন ও শিশু ৬৩ জন। একমাত্র সড়কপথেই নয়, এই সময়ে ৯টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১০ জন এবং ৩২টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ২১ জন নিহত হয়েছেন।

সংগঠনটি ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। এতে বলা হয়, সড়কে প্রতিদিন গড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন। দুর্ঘটনায় দেশের মানবসম্পদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ২১৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা। তবে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক দুর্ঘটনার তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশই পায় না।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১০৭ জনই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। যা মোট প্রাণহানির শতকরা ৩৪ দশমিক ২৯ ভাগ। বিশেষ করে ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সী কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া চালনার কারণে এই চিত্র আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। একাধিক দুর্ঘটনায় বাবা-ছেলে, স্বামী-স্ত্রী ও মা-সন্তান একসঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন।

নিহতদের মধ্যে ৪৪ জন পথচারী, ৫১ জন চালক ও সহকারী এবং ৭৩ জন থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক, সিএনজি, অটোরিকশা) যাত্রী। এছাড়া, স্থানীয়ভাবে তৈরি ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে (নসিমন, ভটভটি, মাহিন্দ্রা প্রভৃতি) প্রাণ হারিয়েছেন ২০ জন।

বিভাগওয়ারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে—১১৬টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮৭ জন। জেলার হিসাবে ফরিদপুরে সবচেয়ে বেশি ২৭টি দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত হন। সবচেয়ে কম প্রাণহানি ঘটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে—সেখানে কোনো মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি। রাজধানী ঢাকায় ৩৮টি দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত ও ৫৩ জন আহত হয়েছেন।

সড়কভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাতীয় মহাসড়কে ১৩৬টি (৩৯ দশমিক ১৯ শতাংশ), আঞ্চলিক সড়কে ১২১টি এবং শহরাঞ্চলে ৫৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার ধরনে দেখা যায়, ১৬৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে চালকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৮১টি মুখোমুখি সংঘর্ষে এবং ৪৬টি পথচারীকে চাপা দিয়ে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষণ বলছে, এবারের ঈদে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ, আর সারাদেশে প্রায় ৪ কোটি মানুষ যাতায়াত করেছেন। ছুটির সময় সীমিত থাকায় একসঙ্গে প্রচুর মানুষ রওনা হন, ফলে গণপরিবহন সংকটে তারা বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে, এমনকি ট্রাক, পিকআপ কিংবা ইজিবাইকেও চড়েন।

এই বিশৃঙ্খলার পেছনে দায়ী করা হয়েছে সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের চলাচল, চালকদের বিশ্রামহীনভাবে গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ট্রাফিক ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং বৈরী আবহাওয়াকে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি নিরাপদ ও স্বাভাবিক ঈদযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে মধ্যমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে—রেল ও নৌপথের উন্নয়ন, ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনের চলাচল বন্ধ, পোশাকশ্রমিকদের ধাপে ধাপে ছুটি, বিআরটিসির রুট সম্প্রসারণ এবং চালকদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন মনে করে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।