জানা নিউজ

বন্যায় ডুবে দুর্গতিতে সিলেটবাসী, শঙ্কা উত্তরাঞ্চলেও

টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢল নামতে থাকায় সিলেট-সুনামগঞ্জের বিশাল জনপদ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে; প্লাবিত হচ্ছে নতুন এলাকা। এতে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতিতে দুর্ভোগ আর কষ্টে সময় কাটছে মানুষের।

ঈদ উৎসব ভেসে গেছে আগেই; বন্যার পানির তোড়ে টিকতে না পেরে অনেকে নিরূপায় হয়ে ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকে এবং রাস্তা ঘাট ডুবে নগরী, জেলা ও উপজেলা শহরের বাসিন্দাদের মতো গ্রামবাসীদের ভোগান্তি উঠেছে চরমে। দৈনন্দিন কাজও বন্ধ প্রায়।

পানি ঘেরা এ অবস্থার মধ্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাসও ভালো খবর দিচ্ছে না। টানা বর্ষণ ও ভারি বৃষ্টিতে কয়েক জেলায় পাহাড় ধসের সর্তকবার্তা দিয়েছে।

সিলেটের এ দুই জেলা ছাড়িয়ে বন্যা এরই মধ্যে উত্তর-পূর্বের জেলা হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও নেত্রকোণাকে ভাসিয়ে দিয়েছে। আর নদ-নদীর দুই কূল উপচে নিম্নাঞ্চল ডুবেছে উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের; বন্যা চোখ রাঙাচ্ছে রংপুর, নীলফামারী ও গাইবান্ধায়।

সেই সঙ্গে নদীর পানি উপচে আরও তিন জেলায় বড় বন্যার ঝুঁকির সর্তকর্তা এসেছে।

বুধবার বিকালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলেছে, টানা বৃষ্টির সঙ্গে বুধবার পর্যন্ত সুরমা, পুরাতন সুরমা, কুশিয়ারা, সারি-গোয়াইন, মনু, ধালাই, খোয়াই, সোমেশ্বরী, তিস্তা ও দুধকুমার- এ দশটি নদ-নদীর ১৩টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে করে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও কুড়িগ্রাম বন্যার কবলেই রয়েছে।

সারা দিন তিস্তার কয়েকটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর পানি প্রবাহের কারণে রংপুর, লালমনিরহাট ও নেত্রকোণার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে এ তিন জেলায় বড় বন্যার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে।

বন্যার কবলে পড়া জেলাগুলোতে সরকারি ত্রাণ তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে বেসরকারি ব্যক্তি ও সংস্থাও।

তবে সিলেটের দুর্গত এলাকার মানুষ বলছে, পানি বাড়তে থাকায় খাবারসহ সব দিক থেকে কষ্ট অসহনীয় হয়ে উঠছে। মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালে নেওয়াও দুরুহ হয়ে পড়ছে। আবার হাসপাতালে পানি ঢোকায় মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবাও।

স্থানীয়দের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে জানা গেছে, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও থাকার জায়গার সংকট ক্রমেই প্রকট হচ্ছে, আশ্রয়কেন্দ্রে বাড়ছে মানুষ; দুর্ভোগে পড়ে ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুও বাড়ছে।

বুধবার দুপুরের পর থেকে বৃষ্টিপাত সেভাবে না হলেও সিলেট অঞ্চলের প্রধান তিন নদী সুরমা, কুশিয়ারা ও সারিগোয়াইনের পানি বিপৎসীমার উপর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে।

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বুধবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে সকাল ৯টার চেয়ে তিন সেন্টিমিটার বেড়ে ৯৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই নদীর সিলেট শহর পয়েন্টে পানি ১ সেন্টিমিটার কমলেও বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এ দিন কুশিয়ারা নদীর পানি জকিগঞ্জের আমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৯৯ ও শেরপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি বয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া সারি-গোয়াইন নদীর সারিঘাট পয়েন্টে কূল উপচে নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

নগরীসহ সিলেটের ১০৬ ইউনিয়নেই বন্যা-

সিলেট মহানগরীকে দুই ভাগে বিভক্ত করা সুরমা নদীর পানিতে তীরবর্তী ওয়ার্ডগুলোর বাসা-বাড়িসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বন্যার্তদের।

সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারের পাশাপাশি বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে সদর, দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বালাগঞ্জসহ মোট ১৩টি উপজেলার ১০৬টি ইউনিয়নে।

সিলেট জেলা আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

বুধবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত মাত্র তিন ঘণ্টায় ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আরও ২৭ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে সময় লাগবে। গত পাঁচ দিনে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ১ হাজার ৬০০ মিলিমিটারের উপরে বৃষ্টি হয়েছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিপাত একটু কমেছে; ১১০ মিলিমিটার হয়েছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, নগরীর ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২২টির ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। নগরীর ৮০টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ২২টিতে মানুষজন উঠেছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় রান্না করা ও শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। নতুন করে কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিরতণ অব্যাহত রয়েছে।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, মহানগরীর ২৩টি ওয়ার্ড ও জেলার ১০৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে ৮ লাখ ২৫ হাজার ২৫৬ জন মানুষ বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন। সিলেট নগরী ও জেলা মিলিয়ে ৬৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে মহানগরে রয়েছে ৮০টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৯ হাজার ৯৫৯ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের ২২৩টি গ্রামের ১ লাখ ২৩ হাজার ৮০০ জন মানুষ বন্যার কবলে পড়েছে, তাদের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে ১ হাজার ৪৪০ জন। উপজেলার প্রধান প্রধান সড়ক ডুবে যাওয়ায় সিলেট জেলার সঙ্গে গোয়াইনঘাটের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

সবচেয়ে বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ১১৩টি গ্রামের ৯৫ হাজার ৫০০ মানুষ বন্যাদুর্গত হয়েছে, যাদের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন ৭ হাজার ৩০৩ জন। উপজেলার বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক বাদে বাকি সব সড়কে পানি উঠেছে, যে কারণে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ নৌকা ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না।

এদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিলেট নগরীর তালতলা, জামতলা, যতরপুর, সোবাহনীঘাট, মেন্দিবাগ ও উপশহর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর রাস্তাঘাট-বাসাবাড়ির কোথাও-কোথাও হাঁটু থেকে কোমর পানিও রয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা নোংরা পানি মাড়িয়ে চলাচল করছেন। পানিবন্দি এলাকার মানুষজন কেউ যাচ্ছেন ভ্যান করে, কেউবা রিকশায়। বিশেষ করে উপশহরের বাসিন্দাদের নৌকা ও ভ্যানে করে চলাচল করতে হচ্ছে।

তালতলা পয়েন্টের ব্যবসায়ী এনামুল হোসেন বলেন, “কয়েকদিন ধরে পানি রয়েছে। তাই দোকান বন্ধ। পয়েন্টের পানি কমছে না। ২০২২ সালের বন্যার কথা মনে হচ্ছে, পানি না কমলে আমাদের গত বন্যার মত কষ্ট ও দুর্ভোগ পোহাতে হবে। দোকান বন্ধ রাখলে পরিবার চলবে কীভাবেম, সে চিন্তাও মাথায় ঘুরছে।”

একই এলাকার ডি ব্লকের বাসিন্দা রুবেল আহমদ বলেন, তাদের তিনতলা বাসার নিচতলায় হাঁটুর উপরে পানি রয়েছে। তাই নিচতলার বাসিন্দরা চলে গেছেন।

একই এলাকার বেগম জাহান (৫০) হাঁটু পানি মাড়িয়ে সোবাহানীঘাট পয়েন্টে এসেছেন। তার ভাষ্য, “বাসার ভেতরে হাঁটু সমান পানি আজ তিন দিন ধরে। রোববার ভোরে পানি ঢুকে ভিজে নষ্ট হয়েছে বাসার জিনিসপত্র। এসব জিনিসপত্রসহ বাসার লোকজন খাটের উপর বসে রাত-দিন কাটাচ্ছে।”

সিলেট নগরীর বন্যাকবলিত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে ত্রাণ বিতরণ করেন দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান। নগরীর বন্যা পরিস্থিতি দেখে তাৎক্ষণিক নগদ ১০ লাখ টাকা, ১০০ টন চাল ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার দেন তিনি।

সুনামগঞ্জে পরিস্থিতির অবনতি, আরও বৃষ্টির আভাস-

বৃষ্টিহীন দুপুর ও রাতে নদীর পানি কিছুটা কমলেও আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে সেই পানির চাপ বাড়ায় নতুন নতুন এলাকা ও রাস্তাঘাট প্লাবিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বন্যা কবলিত মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছে, তবে সেখানে এখনও সরকারিভাবে ত্রাণ দেওয়া হয়নি। আশ্রয় নেওয়া মানুষজন সঙ্গে যা নিয়ে এসেছেন তা দিয়েই দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের।

বন্যা পরিস্থিতি দেখতে বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জে থাকবেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক।

পাউবো সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, সুনামগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সুনামগঞ্জ পয়েন্টে দুপুরে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার এবং ছাতকে ১৪৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বয়ে গেছে। আগামী ৪৯ ঘণ্টায় ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, জেলার দুটি উপজেলা ধর্মপাশা ও মধ্যনগর বাদে বাকি ১০টি উপজেলার ৩টি পৌরসভা ও ৬৯টি ইউনিয়ন মিলে প্রায় পৌনে ৪ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়েছে। দুর্গত এলাকার মানুষের জন্য ৫৩৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এরই মধ্যে সাড়ে ১২ হাজার সেখানে উঠেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলাম প্রাং বলেন, সুনামগঞ্জ সিলেট সড়কের বিভিন্ন স্থান প্লাবিত হলেও ঢাকার সঙ্গে সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ এখনও স্বাভাবিক আছে। তবে সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়ক ও ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ সড়ক ডুবে থাকায় যান চলাচল বন্ধ আছে।

সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এলজিইডির ৯০ ভাগ রাস্তাই পানির নিচে। এগুলো তলিয়ে যাওয়ায় আভ্যন্তরীণ সড়কে যোগাযোগ বন্ধ আছে।

সুনামগঞ্জ মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামসুল করিম বলেন, প্রায় ২ হাজারের বেশি পুকুর ভেসে গেছে। পুকুর মালিকদের বহু টাকার ক্ষতি হবে। পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

হবিগঞ্জে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে, বাঁধে ভাঙন-

হবিগঞ্জের খোয়াই, কুশিয়ারা ও কালনী-কুশিয়ারাসহ সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সদর উপজেলার জালালাবাদ গ্রামে খোয়াই নদীর তীররক্ষা বাঁধ ভেঙেছে।

কুশিয়ারা নদীর তীররক্ষা বাঁধ উপচে নবীগঞ্জ উপজেলার ১০-১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। টানা বর্ষণে হবিগঞ্জ শহরের বেশ কিছু এলাকা ডুবে গেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, সার্কিট হাউজ, অনন্তপুর, মাহমুদাবাদ, শ্যামলী, চৌধুরী বাজারসহ অনেক এলাকার লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা করছেন জেলাবাসী।

পাউবো হবিগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, বৃষ্টির পাশাপাশি ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে খোয়াই, কুশিয়ারা ও কালনী-কুশিয়ারা, সুতাং, করাঙ্গী নদীসহ হাওরে পানি বাড়ছে।

তিনি বলেন, “বুধবারও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। ভারত থেকেও পানি আসছে বিপুল গতিতে। নদীর তীররক্ষা বাঁধে ভাঙন রোধে ৪ হাজার জিও ব্যাগ ও ১২ হাজার সিনথেটিক ব্যাগ মজুদ রাখা হয়েছে। তবে দুপুর ১টার দিকে খোয়াই নদীর বাল্লাহ পয়েন্টে পানি কমতে শুরু করে।”

হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক জিলুফা সুলতানা বলেন, “সম্ভাব্য বন্যা মোকাবেলায় ১৭১ টন চাল, ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও ৭৮ বান্ডিল টিন মজুদ রাখা হয়েছে। ৪২০ টন চাল জেলার ৯টি উপজেলায় পাঠানো হয়েছে।”

বুধবার পর্যন্ত ৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে; প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হবে বলে ভাষ্য জিলুফা সুলতানার।

মৌলভীবাজারেও পরিস্থিতির অবনতি, বাঁধে ভাঙন-

এ জেলাতে বুধবারও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ধলাই ছাড়া বাকি সব নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে বয়ে গেছে। একই সঙ্গে কমলগঞ্জে ধলাই নদীর বাঁধে তিন স্থান ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে।

পাউবো মৌলভীবাজারের প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল বলেন, জুড়ি নদীর পানি বিপৎসীমার ২০৮ সেন্টিমিটার এবং মনু নদীর পানি ৩৫ সেন্টিমিটার ও কুশিয়ারার পানি ২১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা উজানে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা মৌলভীবাজারের মনু, ধালাই ও জুড়ি দিয়ে নেমে আসবে।

তিনি বলেন, বুধবার মৌলভীবাজারে ১১০ মিলিমিটার ও মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী ভারতীয় অঞ্চলে ১০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

ধলাই নদীর কূল উপচে কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চৈতন্যগঞ্জ, রহিমপুর ইউনিয়নের চৈত্রঘাট ও মুন্সিবাজার ইউনিয়নের খুশালপুরে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

পানি প্রবেশ করে কমলগঞ্জ-মৌলভীবাজার সড়কের ছয়কুট এলাকায় এবং আদমপুর ইউনিয়নের কাঁঠালকান্দি-আধাকানি সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। ধলাই নদীর বাঁধের ১০-১২টি স্থান ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।

ভারতের ত্রিপুরার সংবাদমাধ্যম কর্মী দেবাশীষ দত্ত মোবাইল ফোনে বলেন, ত্রিপুরা ও আসামে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছে। এ পানি বাংলাদেশের সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, ধলাই ও খোয়াই নদী দিয়ে বয়ে যায়।

ধলাই নদীর বাঁধের রামপাশা, শিমুলতলাসহ প্রায় ১০টি ভাঙনে ঝুঁকিতে থাকার তথ্য দিয়ে পাউবো মৌলভীবাজারের কর্মকর্তা শাকিব আহমেদ বলেন, বৃষ্টি ও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বাঁধে ভাঙন বাড়তে থাকবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে, প্রস্তুত রাখা হয়েছে সব আশ্রয়কেন্দ্র। ত্রাণও মজুদ আছে।

কুড়িগ্রামে পানি বাড়ছে ধরলা-ব্রহ্মপুত্রে-

কুড়িগ্রামের প্রধান দুই নদী তিস্তা ও দুধকুমার বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যেখানে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানিও বেড়ে বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে।

আগামী ২৪ ঘণ্টায় সব নদ-নদীর পানি বেড়ে কুড়িগ্রামে একটি স্বল্প মেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করছেন জেলার পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাফসান জানি।

বুধবার পাউবোর দেওয়া তথ্যমতে, ২৪ ঘণ্টায় দুধকুমার নদের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার এবং তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ৪২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দুধকুমার নদীর পানি এখন বিপৎসীমার ৯ সেন্টিমিটার এবং তিস্তার পানি ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

অন্যদিকে, ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ৪৬ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে ৩২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার খুব কাছাকাছি রয়েছে।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ১৬২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী কয়েক দিন জেলায় বজ্রসহ ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে।

এদিকে দুধকুমার ও তিস্তার পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার রাজারহাট ও নাগেশ্বরী উপজেলার ১২টি গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে।

পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি হু হু করে বৃদ্ধি পাওয়াতে সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে এবং চিলমারীর কয়েকটি পয়েন্টে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে।

সদর উপজেলার পাঁচগাছি গ্রামের কৃষক জয়নাল শেখ বলেন, “আমার ১৫ শতক জমির সবগুলো পটলের আবাদ ধরলার পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক টাকা লোকসান গুনতে হবে।”

পাউবোর কুড়িগ্রাম নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, “উজানে ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার ভিতরে জেলার সব নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে একটি স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।”

ফুঁসছে তিস্তা: তিন জেলার জন্য খারাপ খবর-

রংপুরের তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে এবং আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রংপুরের স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে জেলার বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

পাউবো নীলফামারী ও রংপুরের কর্মকর্তারা বলেছেন, তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমা ছুই ছুই করছ। এরই মধ্যে তিস্তা ও সানিয়াজান নদী পাড়ের কছিু অঞ্চল প্লাবতি হয়ছে।

পানি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুঁলে রেখেছে র্কতৃপক্ষ।

তিস্তায় পানি বাড়ায় রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা ও গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা অববাহিকার বেশ কয়েকটি এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। কয়েকটি চরাঞ্চলে ঘরবাড়ির চারপাশে পানি উঠে যাওয়ার খবর এসেছে।

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলেছে, বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে বুধবার সকাল ৯টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৯২ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ২৩ সেন্টিমিটার নিচে। এ পয়েন্টে ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে বিপৎসীমা অতিক্রম করে।

পানিয়াল ঘাটের কৃষক আবুজাফর বলেন, “আমি দুই একর জমিতে বাদাম চাষ করেছি। হঠাৎ নদীর পানি বেড়ে আমার প্রায় ১ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। চেয়ারম্যান, মেম্বার বা কেউ আমাদের খোঁজ-খবর নিতে আসেননি।”

মুকুল মিয়ার বাদাম ক্ষেতও পানিতে ভেসে গেছে।

কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, তিস্তা তীরবর্তী কয়েকটি এলাকায় গত দুই সপ্তাহে অন্তত ১৫-২০টি বসতঘর ও স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। হুমকিতে রয়েছে গদাইসহ আশপাশের তিন গ্রামের কয়েকশ বসতভিটা, স্কুল ও মসজিদ।

কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনছার আলী বলেন, তিস্তা তীরবর্তী আবাদি জমি তলিয়ে গিয়ে বাদাম ও শাক-সবজিসহ উঠতি বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হবে। নদীর নিম্নাঞ্চল হালকা প্লাবিত হয়েছে। হঠাৎ পানি বাড়ার ফলে গবাদি পশু নিয়ে মানুষ বিপাকে পড়ার আশঙ্কা করছেন।

এ বিষয়ে কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহিদুল হক বলেন, তিস্তার পানি প্রবাহ বাড়ায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ওই পরিমাণ পানি চরাঞ্চলে প্রবেশ করেনি।

গঙ্গাচড়ার ইউএনও নাহিদ তামান্না বলেন, নদীর চরাঞ্চলে বসবাস করা বাসিন্দাদের উঁচু জায়গায় গবাদি পশুসহ অন্যান্য সামগ্রী রাখার বার্তা দেওয়া হয়েছে।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তায় পানি বাড়তে শুরু করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ডালিয়া পয়েন্টে ব্যারাজের সবকটি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে।

রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, বন্যা মোকাবেলায় মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার তথ্য দিয়েছেন গাইবান্ধার ইউএনও মাহমুদ আল হাসান।

পাহাড়ি ঢলে শেরপুরে আকস্মিক বন্যা-

শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। জেলার সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে।

ঝিনাইগাতী উপজেলা পরিষদের চেয়াম্যান আমিনুল ইসলাম বাদশা বলেন, ঢলের পানির তোড়ে মহারশি নদীর দিঘীরপাড় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে কমপক্ষে ২০টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বুধবার দুপুরে মহারশি নদীর পানি ঝিনাইগাতী সদর বাজারে প্রবেশ করে। ঢলের পানিতে সবজি ও রোপা আমনের বীজতলা ডুবে গেছে।

উপজেলা চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কর্মকর্তা দীঘিরপাড় ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে দ্রুত মেরামতে নির্দেশ দিয়েছেন।

নালিতাবাড়ী উপজেলার চেল্লাখালী এবং ভোগাই নদীর পানি বাড়ছে, তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

পাউবোর শেরপুর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, এখন পর্যন্ত জেলায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।

সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।