বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের অমীমাংসিত ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর সমাধান একবার নয়, দুবার হয়েছে বলে দাবি করেছেন দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। গতকাল রোববার ঢাকায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি এ দাবি করেন। গত এপ্রিলে ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকেও অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান করতে তাগিদ দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানকে। একাত্তরে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা এবং প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পাওনা পরিশোধের বিষয়টি তখন আলোচনায় তোলা হয়েছিল। সে বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, “এই ইস্যুটির সমাধান আসলে দুইবার হয়েছে। একবার ১৯৭৪ সালে, আবার ২০০০ এর শুরুর দিকে, যখন জেনারেল (পারভেজ) মোশাররফ এখানে এসেছিলেন। তিনি গোটা পাকিস্তান জাতির পক্ষ থেকে গোটা বাংলাদেশ জাতির উদ্দেশ্যে কথাটা বলেছিলেন।” পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়ে আপনার প্রশ্নৃ দেখুন, প্রিয় ভাই, ১৯৭৪ সালে ইস্যুটি লিখিতভাবে সমাধান হয়েছে। এই ডকুমেন্টটি ঐতিহাসিক এবং দুই দেশের কাছেই আছে। “আর তারপর, যখন জেনারেল মোশাররফ এখানে এসেছিলেন; খুব খোলামেলা এবং অকপটে তিনি এই ইস্যুটি তুলে ধরেছিলেন। এবং আমি মনে করি, পরিবারের মধ্যে, দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো কিছুর একবার সমাধান হলে, সেটা হয়ে গেছে।” ১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে ৩০ লাখ মানুষ নিহত এবং ৩ লাখ নারী ধর্ষিত হওয়ার ঘটনায় পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। অর্ধ শতক পরও পাকিস্তান ৩০ লাখ মানুষ হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেনি, রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমাও চায়নি। ২০০২ সালে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশাররফ বাংলাদেশ সফরে এসে ওই ভূমিকার জন্য সাধারণভাবে ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেছিলেন কেবল। দুই দেশের এক সঙ্গে কাজ করার ‘বিপুল সম্ভাবনা’ আছে মন্তব্য করে ইসহাক দার বলেন, “দুই দেশের মানুষের জন্য আরও ভালো কিছু করার জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই। এটাতেই আমাদের ঐকমত্য এবং আমরা সেটাই করছি।” দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আমরা বিস্তৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিনিয়োগ এবং নিরাপত্তা প্রতিরক্ষায় একযোগে কাজ করাসহ পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছু। “আপনাদের সঙ্গে আমাদের ঐকমত্য আছে, আমাদের মতামতে কোনো ভিন্নতা ছিল না। যা খুবই ভালো বিষয়।” গত এপ্রিলে ঢাকায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের সঙ্গে বাংলাদেশের তখনকার পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের বৈঠকেও অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়। জসীম উদ্দিন সেদিন বলেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান অমীমাংসিত বিষয়গুলো তিনি বৈঠকে তুলেছেন। যেমন- আটকেপড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদান, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রেরিত বিদেশি সাহায্যের অর্থ হস্তান্তর এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া। “আমরা বলেছি, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা পাকিস্তানের সাথে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়সমূহের দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির মাধ্যমে একটি মজবুত, কল্যাণমুখী ও ভবিষ্যৎমুখী সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তানের সহযোগিতা কামনা করি এবং এই লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছি।” জবাবে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কী ছিল-এমন প্রশ্নে জসীম উদ্দিন বলেছিলেন, এসব বিষয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ‘সদিচ্ছা তারা ব্যক্ত করেছেন’। পাওনা অর্থের পরিমাণের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক ডেপুটি চেয়ারম্যানের এক হিসাব অনুযায়ী, পাকিস্তানের কাছে পাওনা আছে ৪ বিলিয়ন ডলার। আরেক হিসাবে বলা আছে, ৪ দশমিক ৩২ বিলিয়ন। পাকিস্তানকে সেটাই বলা হয়েছে। “আরেকটা হচ্ছে, ১৯৭০ সালের নভেম্বরে যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়, সেখানে বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্র এবং সংস্থা ২০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার সমপরিমাণ অর্থ দান করেছিল, সেটাও আমরা এই বৈঠকে হিস্যা চেয়েছি।”
এক চুক্তি, চার সমঝোতা স্মারক সই
রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে গতকাল রোববার দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। ভিসা বিলোপ চুক্তি: দুই দেশের সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের ভিসা বিলোপ চুক্তি সই হয়েছে। সমঝোতা স্মারক: সই হওয়া সমঝোতা স্মারকগুলো (এমওইউ) হলো- দুই দেশের বাণিজ্যবিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন। দুই দেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা। দুই দেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার (বাসস ও এপিপিসি) মধ্যে সহযোগিতা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সঙ্গে পাকিস্তানের ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইসলামাবাদের (আইএসএসআই) সহযোগিতা। সকাল ১০টায় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসার আগে তৌহিদ হোসেন ও ইসহাক দার একান্ত বৈঠকের কথা জানা গেছে। এরপর প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান।