শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও দলটির বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এতে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেন।
এনসিপির নেতারা বলেছেন, “আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে টালবাহানা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হবে, এই সিদ্ধান্ত জনগণ গত বছরের ৫ আগস্টই দিয়েছে। এরপরও কেউ আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করলে জুলাই যোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করবে।”
নাহিদ ইসলাম বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের নয় মাস পরেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিলের দাবিতে আমাদের রাজপথে নামতে হয়েছে- এটা আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতা বলে মনে করি। জাতির কাছে আমাদের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল বিগত ফ্যাসিবাদী আমলের বিচার নিশ্চিত করা এবং দেশের সংস্কার করা। বাংলাদেশের জনগণ এ ২৪ প্রথমবার রাজপথে নেমে আসেনি, জীবন দেয়নি। এর আগে বহুবার এ দেশের মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে জীবন দিয়েছে। ১৯৭১ সালের পরে ১৯৭২ সালে আমার সোনার বাংলার স্বপ্ন মুজিববাদীদের হাতে বেহাত হয়ে গিয়েছিল। দেশটাকে ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা স্বাধীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছিল। মুজিববাদী সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষার অধিকার বঞ্চিত করা হয়েছিল। সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। গণতন্ত্র নামে বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা দেখেছি বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছিল। দেশের জনগণ নব্বইয়ে রাজপথে নেমে স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিল। কিন্তু ৩০ বছর পরে আবারও সেই স্বৈরতন্ত্র ফিরে এসেছিল। আমরা সবাই জানি বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ কীভাবে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে, স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতা যখন তাদের অধিকারের জন্য রাজপথে নেমে এসেছিল, এ দেশের পুলিশ সেনাবাহিনী বিজিবিকে দিয়ে গুলি চালিয়েছিল। আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক দল নয়। নিবন্ধন বাতিল করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। বিগত নয় মাসেও আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা দেখছি যাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, তারা জামিন পেয়ে যাচ্ছে। মামলা-বাণিজ্য করা হচ্ছে। তৃণমূলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে। নির্বাচন কমিশন কার পারপাস সার্ভ করবে। আমরা দেখেছি, কিছু সাংবাদিক প্রশ্ন করছে, শেখ হাসিনা গণহত্যাকারী কি না! সেই সব সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর।”
সমাবেশে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, “আজ থেকে ৯ মাস আগে আগস্টের ৩ তারিখে ঠিক এমন বিকেলে শহীদ মিনারের উন্মুক্ত মঞ্চে দাঁড়িয়ে সবাই এক হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলাম। আজ ২ মে ছাত্র জনতা এক হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আবারও রায় দিয়েছে। আমরা বাংলাদেশে খুনি আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণ চাই।”
সমাবেশে বক্তব্যে এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক তারিকুল ইসলাম বলেছেন,
“গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আমরা টালবাহানা দেখতে পাচ্ছি, এটা লজ্জাজনক। আমাদের হাইকোর্ট দেখাবেন না। হাইকোর্ট দেখে জুলাই বিপ্লব হয়নি। অবিলম্বে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে তারা কোনো আমলাতন্ত্রিক জটিলতা দেখতে চান না। সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আগে আওয়ামী লীগের বিচার ও সংস্কারের পর নির্বাচনে যেতে হবে।”
দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ উদ্দীন মাহাদী বলেন, খুনি হাসিনাকে বাংলাদেশে এনে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাতে হবে। এ ছাড়া মৌলিক সংস্কার ছাড়া আবারও একটি নির্বাচনের দিকে যাওয়া হলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে গাদ্দারি করা হবে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন বলেন, খুনি হাসিনাকে আমরা বিদায় করেছি। এই বিজয় আমাদের ধরে রাখতে হবে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এই বাংলার মাটিতে আওয়ামী লীগ আর কখনো রাজনীতি করতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ।
আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক আতিক মুজাহিদ বলেছেন, আমাদেহ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য আওয়ামী লীগ ও হাসিনার দোসররা হুমকি। এরা বাংলাদেশে থাকতে পারে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব মাহিন সরকার বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে ন্যূনতম টালবাহানা করবেন না। মৌলিক সংস্কারের আগে কোনো নির্বাচন নয়।
দলের যুগ্ম সদস্যসচিব তাহসীন রিয়াজ বলেন, আগামীর রাজনীতি হবে আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশ থেকে ছুড়ে ফেলার রাজনীতি। যে সাংবাদিকেরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছে, তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার রাজনীতি।
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব হুমায়রা নূর বলেন, আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৫ বছর দেশের মানুষকে শোষণ করেছে। দেশের মানুষকে তারা ভোট দিতে দেয়নি। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তার জন্য অবশ্যই দুর্নীতিপরায়ণ, খুনি-গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। দিল্লির ‘প্রেসক্রিপশনে’ বাংলাদেশ আর চলবে না।
এনসিপির সংগঠক রফিকুল ইসলাম আইনী বলেন, গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হতে হবে। এটাই হবে এই সরকারের অন্যতম সংস্কার।
দলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আলী নাছের খান বলেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চলবে কি চলবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেবেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
এনসিপির সংগঠক মোস্তাক আহমেদ শিশির বলেন, এই দেশে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে, সেই সিদ্ধান্ত জনগণ ৫ আগস্টই দিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হলে জুলাই যোদ্ধারা তা প্রতিহত করবে। সংস্কারের আগে কোনো নির্বাচন হবে না।
দলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক সাইফুল্লাহ হায়দার বলেন, বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। সংস্কারের আগে কোনো জাতীয় নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ খালেদ সাইফুল্লাহর বাবা কামরুল হাসানও সমাবেশে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আমার ছেলের বুকে ৭০টা গুলি করা হয়েছিল। একটা মানুষকে মারতে কত গুলি করতে হয়? হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না, স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী হাসিনা ও তার দোসরদের কোনো স্থান হবে না।
সমাবেশে উপস্থিত হয়েছেন এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম, সদস্যসচিব আখতার হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ও দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ।